পশ্চিমবঙ্গের ১০টি প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় – শিক্ষক দিবস উদযাপন
স্বাধীনতার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে ভারতের সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে বহু বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিদের উদ্যোগে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি স্থাপিত হয়, এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে এই বাংলার বুকে। আজকে আমার লেখনীতে রইল পশ্চিমবঙ্গের ১০টি প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় সম্বন্ধে বিশেষ কিছু তথ্য।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
১৮১৭ সালে কলকাতায় রাজা রামমোহন রায়, ডেভিড হেয়ার, স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট, রাজা রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, রাণী রাসমনি ও রসময় দত্তের উদ্যোগে হিন্দু কলেজ নামে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়। হিন্দু কলেজ ভারত সহ গোটা এশিয়া মহাদেশের মধ্যে প্রাচীনতম মহাবিদ্যালয়। ১৮৫৫ সালে হিন্দু কলেজের নাম পরিবর্তিত হয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজ হয় এবং ২০১০ সালে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে।
ভারতীয় হিন্দুদের মূলত ইংরেজি ও ভারতীয় অন্যান্য ভাষার সাথে সাথে ইউরোপ ও এশিয়ার সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি তার যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল, জীবন বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান, রসায়ন, অর্থনীতি, দর্শন, পারফর্মিং আর্টস, বায়োটেকনোলজি, হিন্দি, ইনস্টিটিউট অফ হেলথ সাইন্স, স্কুল অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্স সহ আরও অনেকগুলি বিভাগ রয়েছে।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য নিম্নোক্ত প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটটির লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন।
সেনেট অফ শ্রীরামপুর কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয়)
খ্রিস্ট ধর্মপ্রচারক জোশুয়া মার্শম্যান, উইলিয়াম কেরি ও উইলিয়াম ওয়ার্ড ১৮১৮ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুরে এই মহাবিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮২৯ সালে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে। এটিই ভারতবর্ষের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় মর্যাদাপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সেনেট অফ শ্রীরামপুর কলেজ (বিশ্ববিদ্যালয়) সর্ব প্রথম স্থান অর্জন করে নিয়েছে।
ভারতবর্ষের সকল ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে কলা ও বিজ্ঞান বিষয় শিক্ষা দেওয়াই ছিল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে থিওলজি, ডিভিনিটি, কাউন্সেলিং অ্যান্ড সাইকোথেরাপি, ক্লিনিক্যাল প্যাস্টোরাল কাউন্সেলিং সহ বিভিন্ন কোর্সের ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য নিম্নোক্ত সেনেট অফ শ্রীরামপুর কলেজের (বিশ্ববিদ্যালয়) ওয়েবসাইটটির লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন।
senateofseramporecollege.edu.in
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
আলেকজান্ডার ডাফ, স্যার চার্লস উড, মহারাজা মহেশ্বর সিং বাহাদুর এবং ডঃ ফ্রেডরিক জন, এই চার জন স্বনামধন্য ব্যক্তির উদ্যোগে ১৮৫৭ সালে কলকাতা শহরে স্থাপিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়টি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সারা ভারতে অন্যতম সেরা রাষ্ট্রীয় গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। আজও প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গের এই প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির আওতাধীনে মোট ১৫১টি অনুমোদিত স্নাতক কলেজ এবং ১৬টি ইনস্টিটিউট রয়েছে।
বর্তমানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এগ্রিকালচার, সাইন্স, আর্টস, কমার্স, সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড বিসনেস ম্যানেজমেন্ট, এডুকেশন, জার্নালিজম অ্যান্ড লাইব্রেরি সাইন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, ফাইন আর্টস, মিউজিক সহ বিভিন্ন কোর্সের ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য নিম্নোক্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটটির লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক ১৯০৫ সালে প্রথমে বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট নামে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার একটি প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২২ সালে, এটি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশনাল র্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্ক দ্বারা ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে চতুর্থ স্থান অর্জন করে নিয়েছে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্টস, সাইন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগ রয়েছে।
দক্ষিণ কলকাতার যাদবপুরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষাপ্রাঙ্গণটি অবস্থিত এবং বর্তমানে বিধাননগরে আরও একটি নতুন শিক্ষাপ্রাঙ্গণ তৈরি করা হয়েছে।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য নিম্নোক্ত যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটটির লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুরে অবস্থিত বিশ্বভারতী একটি প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি এই প্রতিষ্ঠানটিকে ‘বিশ্বভারতী' নামে অভিহিত করেছিলেন, যার অর্থ ভারতের সাথে বিশ্বের যোগাযোগ। স্বাধীনতার পূর্বে এই প্রতিষ্ঠানটি একটি মহাবিদ্যালয় ছিল। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৫১ সালে সংসদের একটি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটিকে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্টস, সাইন্স, এগ্রিকালচার, মিউজিক, সহ আরও বিভিন্ন কোর্সের ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
দেশ বিদেশের বহু ছাত্রছাত্রী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে আসেন। অমর্ত্য সেন, সত্যজিৎ রায়, গায়ত্রী দেবী, ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী ছিলেন।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য নিম্নোক্ত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটটির লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, খড়্গপুর
মূলত পশ্চিমবঙ্গের কারিগরি বিদ্যা শিক্ষার প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে খ্যাত এই প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ১৯৫১ সালে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের উদ্যোগে খড়্গপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বর্তমানে আইআইটি খড়্গপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়াও ম্যানেজমেন্ট, আইন, আর্কিটেকচার সহ বিভিন্ন কোর্সের ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ২০০৫-২০০৬ শিক্ষাবর্ষে বিশ্বের প্রথম ৫০০টি অগ্রগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ভারতবর্ষের আইআইটি খড়্গপুর নিজের জায়গা করে নিয়েছিল।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য নিম্নোক্ত আইআইটি খড়্গপুরের ওয়েবসাইটটির লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন।
কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কল্যাণীতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ৪০০ একর জমির ওপর ৩৭টি মহাবিদ্যালয় ( ১৬টি নদীয়ায়, ২০টি মুর্শিদাবাদে ও ১টি উত্তর ২৪ পরগনায়) নিয়ে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করেছে। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইন্স, আর্টস ও বিসনেস, এডুকেশন, ইঞ্জিনিয়ারিং, টেকনোলজি ও ম্যানেজমেন্ট, আইন, মিউজিক ও ফাইন আর্টস বিভাগ রয়েছে।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য নিম্নোক্ত কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটটির লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৫০-এর দশকে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর বর্ধমানের শেষ মহারাজা উদয়চাঁদ মাহতাব তাঁর সম্পূর্ণ সম্পত্তি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে দান করে দেন। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের উদ্যোগে মহারাজার প্রাসাদ প্রাঙ্গণে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক ১৯৬০ সালে বর্ধমানে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীনে মোট ৬টি স্নাতক বিভাগ ও ৩০টি স্নাতক মহাবিদ্যালয় রয়েছে। বর্তমানে ৩০টিরও বেশি স্নাতক এবং ৬৬টি স্নাতকোত্তর কোর্স বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য নিম্নোক্ত বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটটির লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন।
উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়
পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার শিলিগুড়িতে ১৯৬২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি উত্তরবঙ্গের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। পশ্চিমবঙ্গ সহ পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিহার, সিকিম এমনকি প্রতিবেশী দেশ নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশ থেকেও বহু ছাত্রছাত্রী এখানে পড়াশোনা করতে আসেন। বর্তমানে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, ডক্টরেট এবং পোস্ট ডক্টরাল প্রোগ্রামের ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য নিম্নোক্ত উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটটির লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়
১৯৬১ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁর নামে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেয় এবং অবশেষে ১৯৬২ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষাপ্রাঙ্গণটি কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে অবস্থিত এবং দ্বিতীয় শিক্ষাপ্রাঙ্গণটি কাশীপুরে ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের ধারে মরকত কুঞ্জে অবস্থিত। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে মূলত তিনটি বিভাগ রয়েছে- কলা, চারুকলা এবং দৃশ্যকলা। এছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি বি.এড অনুষদও রয়েছে।
বিস্তারিত তথ্যের জন্য নিম্নোক্ত রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটটির লিঙ্কটিতে ক্লিক করুন।
উপরোক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ভারতবর্ষ সহ সারা বিশ্বের দরবারে বাংলার শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে এক আলাদাই মর্যাদা প্রদান করেছে।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.