মালদায় দেখার সেরা জায়গা
গেটওয়ে অফ নর্থবেঙ্গলের কথা উঠলেই সবার প্রথমে একটাই কথা সকলের মনে আসে, সেটা হল মালদার বিশ্ব বিখ্যাত আম। তবে শুধু আমের জন্যই এই স্থানটি বিখ্যাত নয়। ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ এই জায়গাটিতে রয়েছে বহু দর্শনীয় স্থান, যে স্থানগুলি আজও মালদার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের এই জেলাটি ইংলিশ বাজার নামে পরিচিত ছিল। মহানন্দা ও কালিন্দী নদীর সঙ্গমস্থলের পূর্ব দিকে অবস্থিত এই জেলাটির উত্তরে রয়েছে পাণ্ডুয়া এবং দক্ষিণে গৌড়। গৌড় এবং পাণ্ডুয়াকে ঘিরে রয়েছে বহু ঐতিহাসিক কাহিনী। বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধন লক্ষ্য করা যায় এই দুই শহরে। মূলত এই দুই শহরকে কেন্দ্র করে আজকে আমার লেখনীতে আপনাদের জন্য রইল মালদায় দেখার সেরা জায়গা সম্বন্ধে বিশেষ কিছু তথ্য।
লুকোচুরি গেট
মালদার সেরা দেখার জায়গা হিসাবে লুকোচুরি গেট একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য। লুকোচুরি গেট বা লুকোচুরি দরওয়াজা কে নির্মাণ করেছিলেন সেই নিয়ে বহু মতভেদ আছে। ১৬৫৫ সালে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র তৎকালীন বাংলার সুবেদার শাহ সুজা গৌড়ে এই শাহী দরওয়াজাটি নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়, আবার কিছু ঐতিহাসিকদের মতানুসারে এই মুঘল স্থাপত্যটি ১৫২২ সালে আলাউদ্দিন হোসেন শাহ নির্মাণ করেছিলেন। এই দ্বিতল দরওয়াজাটি গৌড় দুর্গের পূর্ব দিকে অবস্থিত এবং সেই সময় দুর্গের প্রধান প্রবেশ দ্বার হিসেবে ব্যবহৃত হত। এর উপরিভাগকে সম্ভবত নহবতখানা হিসাবে ব্যবহার করা হত। তৎকালীন মুঘল স্থাপত্যশৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন এই লুকোচুরি দরওয়াজা।
চিকা মসজিদ
চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক আরও একটি মালদায় দেখার সেরা জায়গা সম্বন্ধে। ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদটি সুলতান ইউসুফ শাহ গৌড়ে নির্মাণ করেছিলেন। তবে এই স্থাপত্যটি আদতে মসজিদ না সমাধিস্থল তা নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব আছে। জনশ্রুতি রয়েছে সুলতান হুসেন শাহের আমলে ইহা কারাগার রূপে ব্যবহৃত হত। একদা এই মসজিদ হয়ে উঠেছিল চামচিকাদের আশ্রয়স্থল, তাই এই মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে চিকা বা চামকান মসজিদ। বহু কারুকার্য করা পাথর ও মীনা করা ইঁট হিন্দু মন্দির থেকে নিয়ে এসে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই কারণে এটি একটি মুসলিম স্থাপত্য হওয়া স্বত্ত্বেও হিন্দু স্থাপত্যকলার চিহ্নও রয়েছে এই মসজিদে।
দাখিল দরওয়াজা
মালদার গৌড় শহরে অবস্থিত আরও একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য দাখিল দরওয়াজা। ইহা ১৪২৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয়েছিল। সেই সময় গৌড় দুর্গের প্রধান প্রবেশদ্বার হিসাবে ব্যবহৃত হত এই দরওয়াজাটি। ইহার অলঙ্করণে কোন রকম প্রাচুর্য লক্ষ্য করা যায় না। সমসাময়িক অন্যান্য স্থাপত্যগুলির মতোই পোড়ামাটির শিল্পশৈলীর দ্বারা এই প্রাচীন দরওয়াজাটির অলঙ্করণ করা হয়েছিল। বাংলায় মুসলিম শাসন আমলে নির্মিত এই প্রবেশদ্বারটি ইহার সুদৃঢ় নির্মাণশৈলী ও বিশাল আকৃতির জন্য মালদায় দেখার সেরা জায়গা হিসাবে পর্যটকদের কাছে বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
ফিরোজ মিনার
দাখিল দরওয়াজা থেকে মাত্র ১ কিলোমিটার গেলেই আপনি পৌঁছে যাবেন ফিরোজ মিনার। সম্ভবত সুলতান সৈফুদ্দিন ফিরোজই ১৪৮৬ থেকে ১৪৮৯ সালের মধ্যে এই মিনারটি নির্মাণ করেছিলেন। পাঁচতল বিশিষ্ট এই মিনারটির উচ্চতা প্রায় ২৫.৬০ মিটার এবং মোট তিয়াত্তরটি ধাপ বিশিষ্ট সর্পিল সিঁড়ি পেরিয়ে ইহার শীর্ষে পৌঁছানো যায়। দিল্লির কুতুব মিনারের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিল এই মিনারটি। এই প্রাচীন মিনারটি তুঘলকি স্থাপত্যশৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন। পোড়ামাটির নিখুঁত শিল্পশৈলীও লক্ষ্য করা যায় এই মিনারের দেওয়ালগুলিতে। এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি পীর আশা মন্দির বা চেরাগদানি নামেও খ্যাত।
রামকেলি
মালদা থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে গৌড়ের পথে যেতে একটি ছোট্ট গ্রাম রামকেলি। এই গ্রামটি গুপ্ত বৃন্দাবন নামেও পরিচিত। শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর পূর্বে মালদার রামকেলি গ্রামে পদার্পণ করেছিলেন। বৃন্দাবনে যাওয়ার আগে কিছু দিনের জন্য তিনি এই গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁর পদচিহ্ন এখানকার এক প্রসিদ্ধ মন্দিরে আজও সযত্নে সংরক্ষিত আছে। রামকেলিতে রূপসাগর, শ্যামকুণ্ড, রাধাকুণ্ড, ললিতাকুণ্ড, বিষখাকুণ্ড, সুরভীকুণ্ড, রঞ্জকুণ্ড ও ইন্দুলেখাকুণ্ড এই আটটি কুণ্ড দ্বারা সেই পদচিহ্ন পরিবেষ্টিত আছে। এখানে প্রতিবছর জ্যৈষ্ঠ সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু হয় এক গ্রামীণ মেলা। এই মেলায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের পসার নিয়ে বসে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা এমনকি বাংলাদেশ থেকেও ভক্ত দর্শনার্থীদের ভিড় জমে এই মেলায়। সারা দিন ধরে চলে কীর্তন। গ্রামবাসীদের মনোরঞ্জনের জন্য যাত্রাপালার আসর বসে এই সময়। ধর্মীয় তাৎপর্যের দিক দিয়ে মালদায় দেখার সেরা জায়গা হিসাবে এই রামকেলি গ্রাম যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান।
বারোদুয়ারি মসজিদ
রামকেলি গ্রাম থেকে মাত্র পাঁচশো মিটার দূরে গৌড়ে অবস্থিত বারোদুয়ারি মসজিদ। এই বিশালাকার প্রাচীন মসজিদটি গৌড়ের বৃহত্তম স্মৃতিস্তম্ভ। বারোদুয়ারি নামটি থেকে মনে হতে পারে ইহার বারোটি দুয়ার আছে, কিন্তু আসলে এই মসজিদটির মোট এগারোটি দুয়ার আছে। আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসন আমলে এই মসজিদটির নির্মাণ কার্য শুরু হয়েছিল। সেই নির্মাণ কার্য ১৫২৬ সালে তাঁর পুত্র নাসিরুদ্দিন নুসরাত শাহ সম্পন্ন করেন। বারোদুয়ারি মসজিদে লক্ষ্য করা যায় ইন্দো আরবি স্থাপত্যশৈলীর ছোঁয়া। সেই সময় পাথর খোদাই করে এই বিশাল আয়তকার মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
আদিনা মসজিদ
মালদায় দেখার সেরা জায়গা হিসেবে সুলতান সিকান্দার শাহের নির্মিত আদিনা মসজিদ নিজের এক বিশেষে জায়গা করে নিয়েছে। ১৩৬৯ সালে এই মসজিদটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদেরই একটি কক্ষে সুলতান সিকান্দার শাহকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
ভারতের অন্যতম বৃহৎ মসজিদগুলির মধ্যে পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদের নাম উল্লেখযোগ্য। অষ্টম শতাব্দীতে নির্মিত দামাস্কাসের মসজিদের নকশার অনুকরণে এই মসজিদটির নকশা করা হয়েছিল। তৎকালীন সর্বোত্তম স্থাপত্যশৈলীর এক অপরূপ নিদর্শন এই আদিনা মসজিদ।
একলাখী সমাধিসৌধ
মালদা জেলার পাণ্ডুয়ায় আনুমানিক ১৪১২-১৪১৫ সালে এই সমাধিসৌধটি নির্মিত হয়েছিল। একলাখী সমাধিসৌধে মোট তিনটি সমাধি রয়েছে। অনুমান করা হয় এর মধ্যে একটি সমাধি রাজা গণেশের পুত্র জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহের এবং বাকী দুটি সমাধি তাঁর স্ত্রী ও পুত্র শামসুদ্দিন আহমদ শাহের। জালালুদ্দিন মুহম্মদ শাহ ছিলেন বাংলার প্রথম স্থানীয় মুসলিম রাজা এবং বাংলার শেষ সুলতান। তিনি জন্মগতসূত্রে হিন্দু হলেও পরবর্তীকালে ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন।
সেই সময়ে এই সমাধিটি নির্মাণ করতে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল, তাই ইহার এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। এই সুপ্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপত্যটি প্রাক-ইসলামী বাংলার ইঁটের তৈরি মন্দিরের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছিল। এই সমাধিসৌধটির দেওয়াল গাত্রে রয়েছে অপরূপ পোড়ামাটির অলঙ্করণ।

জগজীবনপুর
মালদার হবিপুর ব্লকে জগজীবনপুর নামে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান রয়েছে। পাল সম্রাট মহেন্দ্রপালদেবের একটি তাম্র ফলক শিলালিপি এই স্থান থেকে আবিষ্কৃত হয়েছিল। এছাড়াও এই স্থানে রয়েছে নবম শতাব্দীর একটি বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ নন্দদীর্ঘিকা-উদ্রাঙ্গ মহাবিহার। এই স্থানটিতে অনেকগুলি ঢিবি রয়েছে, যেগুলির মধ্যে সর্ব বৃহৎ ঢিবিটির নাম তুলাঢিবি বা সালাইডাঙ্গা। এছাড়া আখড়িডাঙ্গা, নিমডাঙ্গা, নন্দনগড় ও রাজার মায়ার ঢিপি নামক আরও চারটি ঢিপি রয়েছে এখানে। এছাড়াও এখনও এখানে বিশাল এলাকা জুড়ে রয়েছে নন্দাদিঘি নামক একটি দীঘি।
মালদা মিউজিয়াম
১৯৩৭ সালে এই প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরটি মালদা জেলায় নির্মাণ করা হয়েছিল। এই মিউজিয়ামটিতে মালদা জেলা থেকে প্রাপ্ত সমস্ত ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলি সংরক্ষিত রয়েছে। সেই নিদর্শনগুলি বর্তমানে দাঁড়িয়ে আমাদের চোখের সামনে অতীতের ছবি তুলে ধরে।
আদিনা ইকো ট্যুরিজম পার্ক
ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলি ছাড়াও মালদা জেলার আদিনায় রয়েছে একটি সবুজে ঘেরা ইকো ট্যুরিজম পার্ক। বিভিন্ন ধরণের গাছ-গাছালি এবং নানান ধরণের রঙিন সামুদ্রিক মাছ রয়েছে এখানে, সব মিলিয়ে এই ইকো ট্যুরিজম পার্কটির মনোরম পরিবেশ পর্যটকদের বেশ আকর্ষণ করে।

Author
Moumita Sadhukhan
A big foodie and a fun-loving person, love to explore the beauty of nature and want to introduce Indian cultural heritage to the future generation.